বাজারে নতুন পত্রিকা আসছে- এমন খবর শুনেই স্বপ্নে ভাসি আমরা। কি দুর্দমনীয় সে স্বপ্নগুলো তাড়া করে ফেরে আমাদের। ভাবতে থাকি- নতুন চিঠি আসছে নীলাকাশ থেকে, নীল খামে। যেন প্রথম প্রেমের প্রথম চিঠি। কী অদ্ভুত কাঁপা কাঁপা অনুভূতি।
আমরা এক একজন ‘ডাকঘরের’ সেই ‘অমল’। ‘রাজার’ চিঠির জন্য কী অধীর অপেক্ষা। নতুন পত্রিকা বার বারই আসে। বার বারই আমাদের গচ্ছিত স্বপ্নগুলো হুমড়ি খেয়ে পড়ে। হয়তো নতুন দিন, নতুন দিগন্তের দেখা পাব। নতুন চিঠি আমাদের সম্মিলিত নীবরতাকে সরব করে দেবে। রাজার আজ্ঞাবহ নয়, নয় লাজ-লজ্জারাঙা কিশোরী কিংবা গাঁয়ের বধূ। হবে না কখনই দ্বিধান্বিত যুদ্ধসেনা।
প্রবলমাত্রার সুনামির তাণ্ডবে থাকবে শকুনের দৃষ্টি, চিতাবাঘের ক্ষিপ্রতা। কোনো কোনো পত্রিকা আসে চোখের আড়ালে আবডালে। কানাকানি থেকে চুপি চুপি পা পড়ে মাটিতে। আবার কখনও আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে- ঢাক ঢোল পিটিয়ে আসে। জানি গর্জন বড় হলে নদীটা তো আদিগন্তই হয়। রাশি রাশি জলের ঢেউ থাকে। পাড়ে আছড়ে আছড়ে পড়ে। ঢেউয়ের তোড়ে পাড়ও ভাঙে। আমরা যেন পাড় ভাঙা ঢেউয়ের নদী-ই চাই। সবকিছু ভাসিয়ে নিয়ে যাক, ধুয়ে মুছে সাফ করে। চারদিকে আবর্জনা জমেছে রাশি রাশি। আমরা ক্রমাগত ডুবে যাচ্ছি আবর্জনার স্তূপে।
এই আবর্জনা সরাতে আমরা জলোচ্ছ্বাস চাই। প্লাবন চাই। সেই সঙ্গে আলো চাই, উজ্জ্বল দিন চাই৷ নতুন পত্রিকা আসে নতুন সম্ভাবনা-স্বপ্নের ‘প্রমো’ ঝুলিয়ে। আশায় বুক বাঁধেন গণমাধ্যমকর্মীরা। আছড়ে পড়ে অভিনন্দন-এর ঢেউ। বড় প্রতিষ্ঠান, বড় বিনিয়োগ, বড় সম্ভাবনা। কর্মসংস্থানকাতর সংবাদশ্রমিকরা চোখ কচলে ভোরের আলো দেখেন। সংকটে সংকুচিত গণমাধ্যমে প্রতি মুহূর্তের অনিশ্চয়তায় বড় এক নিশ্চয়তার বার্তা। এমন অকালে-আকালে নতুন পত্রিকা কলরব তোলে সরবে, নীরবে। কার? কে? কারা? কোন ইন্ডিকেট-সিন্ডিকেট? এমন হাজারো প্রশ্নের আড়ালে চলে যুক্ত হওয়ার, টিকে থাকার লড়াই।
গণমাধ্যমে প্রকট হয়েছে শ্রেণি সংগ্রাম। এলিট, মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত, অসহায়, নিরন্ন- শ্রেণিতে বিভক্ত এখন সংবাদকর্মীরা। বিনিয়োগকারীদের বাগে আনা রাজনীতির বরপুত্র এলিট সাংবাদিকরা শোষকের ভূমিকায়। শোষিত মধ্যবিত্ত মেধাবী কর্মীরা বিলুপ্তির পথে। নিম্নবিত্ত-অসহায়রা জড়াচ্ছে অপরাধে। পেশাদারিত্বের পারদ শূন্যের দিকে। ক্ষমতার ভরকেন্দ্রিক চাকরিতে পরিণত হচ্ছে সাংবাদিকতা। বড় বিনিয়োগের বড় পত্রিকা মানেই কারো কারো মোটা বেতনের করপোরেট ধারার বড় চাকরি- বিলাসী জীবন। নতুন পত্রিকা মানেই আমজনতার সীমাহীন স্বপ্নের (পড়ুন অলীক) বিপরীতে গণমাধ্যমকর্মীদের সোনার হরিণ ধরার লড়াই। এলিটদের সিন্ডিকেটে যুক্ত হওয়ার কৌশল-অপকৌশলে মেধাবীদের দীর্ঘশ্বাস বাড়ে।
সদ্য পাওয়া বিলাসী সর্বোচ্চ আয়ের পদে দীর্ঘমেয়াদে টিকে থাকার টেকসই পরিকল্পনা করা হয় দারুণ উদ্দীপনায়। কাটছাঁট, অনুকরণ, গতানুগতিক, প্রথাগত চিন্তা আর ধ্যানধারণায় থমকে দাঁড়ানোর আশঙ্কা সারাক্ষণ। নতুন পত্রিকা অবতারণার (মোটের ওপর) দুটি উদ্দেশ্য- কর্মসংস্থান ও ক্যারিয়ার। প্রথমত, চাকরির ব্যবস্থার মাধ্যমে যতদূর সম্ভব নিজেদের টিকিয়ে রাখার চেষ্টা। দ্বিতীয়ত, জনপ্রিয় হয়ে নিজেদের ক্যারিয়ার তুঙ্গে তোলার পরিকল্পনা। এই দুটো দিক বিবেচনা করেই নতুন পত্রিকায় জনবল নিয়োগ প্রক্রিয়া পরিচালিত হয়। সাংবাদিকতায় যারা এলিট শ্রেণির তারা জনপ্রিয়তার মাধ্যমে ক্যারিয়াসহ প্রাতিষ্ঠানিক স্থায়িত্ব চান। জনবল নিয়োগে তাই তারা শীর্ষ বা প্রথম শ্রেণির গণমাধ্যমের কর্মীদেরই টার্গেট করে থাকেন। প্রায় ক্ষেত্রেই রেফারেল পদ্ধতিতে গণমাধ্যমে নিয়োগ প্রক্রিয়ায় নির্দিষ্ট বলয়ের কর্মীরাই বেশি সুযোগ পেয়ে থাকেন।
প্রথাগত ব্যক্তিকেন্দ্রিক ব্যবস্থাপনার কারণে মূল পরিকল্পনা ভাগাভাগি করার সুযোগ থাকে খুব কম। উদ্যোক্তা/মালিক বা সম্পাদকনির্ভর সাংবাদিকতার সূত্র ধরে তাই বহুজনের বহুমুখী ভাবনার সমন্বয় করা সম্ভব হয় না। এখন পর্যন্ত যেকোনো নতুন পত্রিকার বিকাশ পরিকল্পনায় দেশের শীর্ষ জনপ্রিয় পত্রিকার স্টাইলকেই অনুসরণ বা অনুকরণ করা হয়। হুবহু স্টাইলে বা আরো একধাপ এগিয়ে সেটিকেই টপকানোর সব রকম আয়োজন থাকে। সংবাদের স্টাইল বা পরিকল্পনাও সাজানো হয় সেভাবে। কতটা কাছাকাছি পৌছানো সম্ভব হলো সেটাকেই সাফল্য হিসেবে ধরা হয়।
শীর্ষ সেই পত্রিকার সাবেক কর্মীদের হাত ধরেই যখন কোনো নতুন পত্রিকার জন্ম হয়, সেখানে মৌলিকত্ব কিংবা নতুনত্ব থাকার কোনো সুযোগই থাকে না। কারণ কোনো বৃত্তের মধ্যে তার চেয়ে বড় কোনো বৃত্ত আঁকা সম্ভব নয় কখনই। আর বৃত্ত ভাঙতে যে সাহসিকতা আর সৃজনশীলতা প্রয়োজন তার জ্বালানি সরবরাহের পথ রুদ্ধ হয়ে আছে আমাদের প্রথাগত নীতিবোধে। মূলত আমরা যতটা না সৃজনশীল, তার চেয়ে বেশি অনুকরণশীল। সেটা স্টাইল কিংবা পরিকল্পনায়- যেটাই হোক না কেন। ব্যবসা শুরুর আগে বাজার যাচাই করা প্রচলিত উদ্যোক্তা-রীতি।
তবে সংবাদপণ্য উৎপাদনে বড় বিনিয়োগের ক্ষেত্রে পাঠক যাচাই বা জরিপ একেবারেই অনিবার্য। সম্প্রতি সংবাদপণ্য উৎপাদনকারী নতুন পত্রিকা (আজকের পত্রিকা) বাজারে আসার আগে তাদের পণ্য চাহিদা সংক্রান্ত জরিপের ফলাফল প্রকাশ করেছে। মফস্বল ও প্রত্যন্ত এলাকায় পরিচালিত সেই জরিপের ফলাফল মতে, দেশের ৭০ শতাংশ পাঠক এখনও ছাপাপত্রিকা পড়তে চান। সেখানে নিজেদের খবর পেতে চান। এক্ষেত্রে সম্পাদক মনে করেন, ইন্টারনেটসেবা এখনও অনেক প্রান্তিক জায়গায় পৌঁছেনি।
সেখানে পত্রিকার চাহিদা রয়েছে। নতুন পত্রিকা সেখানে যাবে। চমৎকার জরিপ! তবে ঠিক কী ধরনের সংবাদপণ্য মফস্বলের ৭০ শতাংশ ক্রেতা কিনতে চান সে ব্যাপারে বিস্তারিত প্রকাশ করা হয়নি। অবশ্য সেটা নিরূপণ করতে হবে কতটা সুদক্ষ স্থানীয় প্রতিনিধি বাছাই করা হয়েছে আর কী ধরনের সংবাদপণ্য প্রকাশিত হচ্ছে তার ভিত্তিতে। তবে ইতোমধ্যে জানা গেছে, ক্রেতাদের চমকে দেয়া, প্রশাসনের ঘুম ভাঙানো কিংবা ভরকে দেয়ার মতো কোনো রিপোর্ট তারা এখনও বাজারে ছাড়েনি৷
একটিমাত্র পুকুরে শত শত জাল ফেলে সীমিত মাছ শিকারের প্রচলিত যে নগরসাংবাদিকতা সেটা ছেড়ে প্রান্ত বা ব্রাত্যজনকে সংবাদক্রেতা বানানোর উদ্যোগটি অবশ্যই অসাধারণ বিজনেস পলিসি। অনলাইনের এই মহামারিকালে তাদের অভিনন্দন জানাতেই হবে। হয়তো, একজন কৃষককে শেকসপিয়রের পাঠক বানানোর উদ্যোগ শত শত পাঠাগার স্থাপনের চেয়েও উত্তম। তবে আরো বেশি উত্তম- চহিদা মোতাবেক ক্রেতার কাছে সংবাদপণ্য পৌঁছে দেয়ার দায়-দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন।
কারণ, জ্ঞান শুধু মন-মননকে আলোকিত করে পৃথিবী বদলে দিতে পারে; আর সঠিক তথ্য নাগরিক অধিকার বিষয়ে প্রশাসনের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করে। যা নাগরিক জীবনকে সুন্দরভাবে বেঁচে থাকার নিশ্চয়তা দেয়। আর জীবন বাঁচলেই কেবল জ্ঞান অর্থময় হয়।